মহাকাশের দুর দুরান্ত থেকে প্রতি মুহুর্তে ভেসে আসছে নানা ধরনের বেতার তরঙ্গ। বিজ্ঞানীরা রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে সেই তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে চলেছেন। এ কাজে এখন সাহায্য করছে কম্পউটার। জানা যাচ্ছে কতো বিশ্বাল এই মহাবিশ্ব। এই বিশালতার কথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। রীতিমতো শিহরিত হতে হয়।
প্রাচীনকালের মানুষ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতো রাতের আকাশের দিকে। কৌতুহলী হতো। প্রাচীন মানুষের এই কৌতুহলের প্রমাণ পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের দক্ষিণ কোনে সলসবেরীতে। যেখানে ষ্টোনহেঞ্জ নামে পুরাকীর্তি আবিস্কৃত হয়েছে। বড় বড় পাথর সাজিয়ে প্রাচীন কালের মানুষ আকাশ পর্যবেক্ষণ যন্ত্রপাতি বনিয়েছিল। পাথরের থামের উপর নির্ভূল মাপে দাগ কেটেছিল। এর ফলে লিবিয়া ও মিডাসের যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল। খালি চোখে দেখার ক্ষমতা আর কতটুকু? কাঁচ ঘষে আবিষ্কৃত হলো লেনস। তৈরি হলো দূরবিন। এতে গ্রহ নক্ষত্র দেখার কাজটা অনেক সহজ হয়ে এলো।
১৬০৯ সালে ইতালির গ্যালিলও প্রথম দুরবিন বানিয়েছিলেন। তিনি দুর আকাশের অনেক বিস্ময়কর তথ্য আবিস্কার করেছিলেন। গ্যলিলিও তার দুরবিন দিয়ে প্রথম বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ দেখতে পেলেন। তিনি যখন বললেন যে বৃহস্তপতির চারটি চাঁদ রয়েছে তখন লোকেরা তাকে উপহাস করেছিল। সেই চারটি উপগ্রহের নাম দেয়া হলো গ্যানিমিড, ক্যালিষ্টো, আইও ও ইউরো। সেই থেকে বিশাল মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খোঁজ নেবার শুরু।
১৬১০ সালে গ্যালিলিও শনি গ্রহের রহস্যময় বলায়ের কথা প্রথম জানালেন। ঐ বলয়
লক্ষ লক্ষ গ্রহানু দিয়ে তৈরি। গ্রহানুগুলো একসাথে ঝাঁক বেঁধে আছে। আশ্চর্য এক
নিয়েমে শনিকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে।
মহাবিশ্বে রয়েছে
এমনি অনেক রহস্যময় ঘটনা। মানুষ মহাশূন্যের কথা ভেবে আলোড়িত। কৌতুহলী হয়ে জানতে
চেয়েছে সৃষ্টি রহস্যের কথা। কোথা থেকে এলো এ গ্রহ লক্ষত্র?
দূরবিন তৈরির ক্ষেত্রেও প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে। এখন আলোক দূরবিন আর বেতার দূরবিন দিয়ে দূর মহাবিশ্বের অনুসন্ধান চলছে। রাশিয়ার সোমিরোড্রিকি পাহাড়ে বসানো হয়েছে ২৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের প্রতিফলক দুরবিন। সেই দূরবিনের সাহায্যে মহাবিশ্বের বিশাল পরিসরের একটি ধারণা পাওয়া গেল। আমাদের এই সৌর পরিবার একটি ছায়াপথের অন্তর্গত। একে বলে গ্যালাকসি। এই ছায়াপথে রয়েছে আনুমানিক
250,000 মিলিয়ন লক্ষত্র। এক মিলিয়ন মানে দশ লক্ষ। তাহলেই বোঝা যায় কি বিশাল এই গ্যালাকসির আকার। এই গ্যালাকসি রয়েছে আবার আরো বিশাল গ্যালাকসিপুঞ্জের মাঝে।
সোমিরোড্রিকির দূরবিন দিয়ে বিস্ময়কর সব তথ্য জানা যেতে লাগলো। মোট একুশটি গ্যালাকসি নিয়ে এই গুঞ্জ গঠিত। আর এটা যে পরিামন জায়গা জুড়ে আছে তা হলো ত্রিশ লক্ষ আলোক বর্ষ।
আলোর গতিবেগ হলো প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল অর্থত গ্যালাকসিগুঞ্জের শেষ নক্ষত্র
থেকে যদি আলো আসতে থাকে তবে পৃথিবীতে এসে পৌছাতে লাগবে ত্রিশ লক্ষ বছর।
বিজ্ঞানীরা ক্রমে
ক্রমে আরো বিশাল জগতের সন্ধান পেতে লাগলেন। জানা গেল আমাদের গ্যালাকসিপুঞ্জ থেকে
পাঁচ কোটি আলোক বর্ষ দূরে আছে আরো একটি গ্যালাকসিপুঞ্জ। নাম ভারগো গুচ্ছ। তার
অন্তর্গত রয়েছে এক হাজার গ্যালাকসি। বিজ্ঞানীরা এখন আরো শক্তিশালী দূরবিন তৈরি
করার চেষ্টা করছেন।
অনেক নক্ষত্রে
তাপ পরমানুর ক্রিয়া চলে। সেখান থেকে নিক্ষিপ্ত হয় বেতার তরঙ্গ। আলোক দূরবিন দিয় ঐ
তরঙ্গ ধরা যায় না। ফলে এদের কথা জানা যেত না। বিজ্ঞানীরা এসব লক্ষত্রের অস্তিত্ব
জানার জন্যে ব্যবাহার করছেন বেতার দূরবিন।
মহাকাশের বেতার তরঙ্গ এই দুরবিনের গ্রাহক চাকতিতে এসে আছড়ে
পড়ে। সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে যায় কেন্দ্রে। সেখানে বিশ্লেষণ করা হয় সংকেতগুলো।
সবচাইতে রয়েছে বড়
বেতার দূরবিন রয়েছে পশ্চিম জার্মানীতে। ম্যাক্স প্লাঙ্ক গবেষনা কেন্দ্র। সেখানকার
গ্রাহক চাকতির ব্যাস হলো 328 ফুট।
সবচাইতে
শক্তিশালী বেতার দূরবিনটি রয়েছ নিউ মেকসিকোতে। যার এক একটি বাহু লম্বায় 13মাইল। সেখানে
পর পর বসানো 27টি বেতার এরিয়াল চাকতি। যার প্রত্যেকটির ব্যাস হলো 82ফুট।
এখণ মহাকাশযানের
সাথে. উপগ্রতের সাথে সংযুক্ত থাকছে দুরবিন। অবলোহিত রশ্মি এবং কম্পিউটার লাগানো
রয়েছে সেসব দুরবিন। এসব দুরবিনে বসানো হয়েছে লেসার য্ন্ত্র। মহাশূন্যের সুক্ষ্মতম
খবরও যেন জানা যায়। সুক্ষ্মতম হিশেব মাপার ব্যাপারে লেসার রশ্মি খুব কার্যকর।
এসব দূরবিনের
সাহায্যে এখন ব্ল্যাক হোল, পালসার, কোয়েসারের নানা রহস্যময়, চমকপ্রদ খবর জানা
যাচ্ছে।
মহাবিশ্বের
বিচিত্র রহস্য অনুসন্ধানের জন্যে গড়ে উঠলো বিজ্ঞানের নানা শাখা। মাহাকশ থেকে আসা
আলো ও বেতার তরঙ্গ বিশ্লেষণ পদ্ধতি।
১৯১২ সালে প্রথম
জানা গেল মাহজাগতিক রশ্মির কথা। আষ্ট্রিয়ার এক বিজ্ঞানী ভিকতার হেস এই তথ্য প্রকাশ
করলেন। তিনি জানালেন, মহাকাশ থেকে অতি উচ্চ শক্তির এক রকম কণিকা স্রোত আসছে।
এ নিয়ে শুরু হলো
ব্যাপক পরীক্ষা।
১৯৩১ সালে হঠাৎ করে মহাকাশে খোঁজ পাওয়া গেল নতুন
রকমের এক উৎসের। যা থেকে আসছে বেতার তরঙ্গের
স্রোত গবেষনায় জানা গের এই প্রবাহ আসছে সৌর জগতের বইরে থেকে। এর উতস রয়েছে ছায়াপথ
তারা জগতের কেন্দ্রে।
এই গবেষণার
প্রধান ব্যক্তি ছিলেন বিজ্ঞানী কার্ল জানস্কি। তিনি এমন একটি বেতার যন্ত্র বানালেন
যাতে কোন বিশেষ দিক থেকে আসা বেতার তরঙ্গ প্রবাহ ধরতে পার। তিনি দেখলেন রোজ প্রায়
একই সময়ে ঘন্টা ছয়েকের জন্যে প্রবাহের মান বেড়ে যাচ্ছে। দেশ বিদেশের বিজ্ঞানীরা
গভীর কৌতুহলের সাথে মহাবিশ্বের বিশালতার অনুসন্ধান শুরু করলো। মহাবিশ্বের বেতার
উতসের খোঁজ শুরু হলো।
ইংল্যান্ডের
ছড়ানো রয়েছে বহু ধরনের বস্তুপিন্ড। জ্যোতিস্ক। এসব থেকে হচ্ছে বিকিরণ। আসছে কণিকার
স্রোত। এতে একটা সমস্যা দেখা দিলো। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে এই বিকিরণ আসতো বলে
তার যথার্থ রূপ জানা যেত না। কারণ মহাজাগতিক রশ্মির কণিকাগুলো বায়ুমন্ডলের অণু
পরমাণুর আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হতো। এতে মৌলিক কণিকা পৃথিবীতে আসতো গৌণ কণিকা রূপে।
তাই বিজ্ঞানীরা অনুভব করলেন এদের যথার্থ রূপ জানতে হলে এমন যন্ত্র পাঠাতে হবে
যা বায়ুমন্ডলকে অতিক্রম করে মহাশূন্যে যাবে। এ ব্যাপারে সাহায্য করলো রকেট
প্রযুক্তি।
১৯৪৬ সালের ১০ই
অক্টোবর তারিখে একটি ভি-২ রকেটের সাহায্যে অতি বেগুনী আলোর বর্ণালী বিশ্লেষক
যন্ত্র নিক্ষিপ্ত হলো। তাতে ধরা পড়লো সূযের্র আলোর বর্ণলিপি। এই যাত্রা
বিজ্ঞানীদের কাছে নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিল।
অনেকেই তাই ঐ
তারিখটিকে মহাকাশ বিজ্ঞানের জন্মদিন হিশেবে আখ্যা দিলেন। এখন এই প্রযুক্তির
ক্ষেত্রে বিস্ময়কর রকমের অগ্রগতি ঘটেছে।